ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স এর মধ্যাকার পার্থক্য কী?

ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগের নাম শুনে নি এমন লোক খুজে পাওয়া দায়। অনেকেই আবার ছোট বেলা থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য নিজের জীবনের লক্ষ নির্ধারন করে থাকে। বাংলাদেশের মানুষের জীবনের লক্ষই হলো হয় ডাক্তার, আর নয় ইঞ্জিনিয়ার। আর যারা ইঞ্জিনিয়ারিং করতে চায় তাদের মাথায় যে সকল বিভাগ নিয়ে পড়াশোনার আগ্রহ থাকে তার ভিতরে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স অন্যতম। ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগকে প্রকৌশল বিভাগের আত্না বলা হয়ে থাকে।

ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স যদিও অনেকে একই রকম মনে করেন, আসলে বিষয় দুটির ভিতরে কিছুটা তফাৎ রয়েছে। এখানে একটি কথা বলে রাখি ইলেকট্রিক্যাল বিভাগ থেকেই কিন্তু ইলেকট্রনিক্স বিভাগের উৎপত্তি। আমাদের ভিতরে অনেকেই আছেন যারা ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স এর মধ্যাকার পার্থক্য কী এটাই জানে না। আজকে আপনাদের মাঝে সহজভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করব ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগের পার্থক্য নিয়ে। পুরো পোস্ট পড়লে আপনারো আর ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগ নিয়ে আর কোন কনফিউশন থাকবে না।

যারা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চান বা পরিচিত কাউকে পড়াতে চান তাদের অনেকের ভিতরে প্রশ্ন থাকে যে আমি কি ইলেকট্রিক্যাল নিয়ে পড়াশোনা করবো নাকি ইলেকট্রনিক্স নিয়ে? তাদের জন্য একটি কথা বলি বিশ্বের অন্যদেশগুলোতে ইলেকট্রনিক্স এর জব বেশি থাকলেও বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক্স ডিপার্টমেন্টের জব তুলনামূলক ভাবে নাই বললেই চলে। 

অপরদিকে ইলেকট্রিক্যাল বিভাগে কেউ যদি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিংয়ারিং করতে চান তাদের জন্য বাংলাদেশে ভালো ভালো জব আছে। আমরা সকলে পড়ালেখা করি ভালো চাকুরির জন্য তাই আমার মতে আপনারা পছন্দের তালিকায় অবশ্যই ইলেকট্রিক্যাল বিভাগকে এগিয়ে রাখবেন।

আরো পড়ুনঃ বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ বিল কমানোর কার্যকর উপায়।

তবে যারা এইচএসসি (HSC) কমপ্লিট করে বিএসসি (B.sc) করতে চান তাদের কিন্তু দুইটি বিষয়কে একত্রিত করেই পড়ানো হয়ে থাকে। আমরা অনেকে ত্রিপল ই (EEE) বিভাগের নাম শুনেছি। ত্রিপল ই-এর পুরো অর্থ হলো ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং ( EEE = Electrical and Electronics Engineering) । তাই বিএসসি করতে হলে অবশ্যই আপনাকে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স দুই বিষয় নিয়েই পড়তে হবে।

ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স কি

ইলেকট্রিক্যাল বিভাগঃ ইলেকট্রিক্যাল হল বিজ্ঞানের এমন একটি গুরুত্বপূর্ন শাখা যেখানে পরিবাহি পদার্থ ও অপরিবাহী পদার্থ নিয়ে সকল বিষয়ের উপর নিখুতভাবে আলোচনা ও গবেষনা করা হয়ে থাকে। ইলেকট্রিক্যাল বিভাগের সজ্ঞা দিতে গেলে বলতে হবে ইলেকট্রিক্যাল হল ইঞ্জিনিয়ারিং এর এমন একটি শাখা যেখানে (Conductor) পরিবাহির ভিতরে ইলেকট্রন প্রবাহ এবং পরিবাহি দ্বারা তৈরি বস্তু নিয়ে আলোচনা করা হয়। যেমন- জেনারেটর, মটর, সার্কিট ব্রেকার, ম্যাগনেটিক কন্টাক্টর, ফ্যান, সুইচগিয়ার ইত্যাদি।
ইলেকট্রিক্যাল বিভাগের এ শাখায় বিদ্যুতের উৎস, অল্টারনেটিং কারেন্ট (AC) ও ইলেকট্রিক্যাল সার্কিটের উপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়ে থাকে।

ইলেকট্রনিক্স বিভাগঃ বিজ্ঞানের যে শাখায় মূলত অর্ধ-পরিবাহি পদার্থের ভিতরে প্রবাহিত ইলেকট্রন ও হোল চার্জের প্রবাহ এবং সেমিকন্ডাক্টর দ্বারা তৈরি বস্তু বা এমন পদার্থ যেগুলো সেমিকন্ডাক্টরের মত আচরন করে এমন পদার্থ নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকে ইলেকট্রনিক্স বিভাগ বলে। যেমন- ডায়োড, ট্রানজিস্টর, জে-ফেট, মসফেট, ভ্যাকুয়াম টিউব, এসসিআর, থাইরেস্টর, ডায়াক, ট্রায়াক, এমপ্লিফায়ার, ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (IC), অসিলেটর, ফ্লিপ-ফ্লপ, রেজিস্টার, কাউন্টার, লজিকগেট, মাইক্রোকন্ট্রোলার ইত্যাদি।
ইলেকট্রনিক্স বিভাগের সকল যন্ত্রাংশ ডিসি বিদ্যুৎ দ্বারা পরিচালিত হয়। এবং সকল প্রকার ইলেকট্রনিক্স সার্কিটের উপর আলোচনা করা হয়ে থাকে।

ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স এর মধ্যাকার পার্থক্য কী?

ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স এর পার্থক্য

আমাদের বাসাবাড়িতে বিদ্যুতের অনেক সরঞ্জাম ব্যবহার করে থাকি, যেমন- ফ্যান, লাইট, টেলিভিশন, কম্পিউটার, সার্কিট ব্রেকার, এসি, ফ্রিজ, মোবাইল ইত্যাদি। এসকল জিনিসের কিছু আছে ইলেকট্রিক্যাল আর কিছু ইলেকট্রনিক্স। 

আমরা কিভাবে বুঝতে পারবো যে কোনটা ইলেকট্রিক্যাল আর কোনটা ইলেকট্রনিক্স? এটা বুঝতে হলে কিছু বেসিক পার্থক্য আপনাকে লক্ষ করতে হবে। ফ্যান, লাইট, সার্কিট ব্রেকার ইত্যাদিতে বিদ্যুৎ সরবারহ করলে সরাসরি এসি কারেন্ট প্রবাহিত হয় এগুলোতে তাই এ ধরনের ডিভাইসগুলো ইলেকট্রিক্যাল।

আর ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসগুলো সাধারনত চার্জিং সিস্টেমে চলে যেমন- মোবাইল, টেলিভিশন ইত্যাদি। যদিও বাস্তবে আমরা হয়তো ভাবি যে এখানেও তো প্লাগের মাধ্যমে এসি সাপ্লাই দিলাম কিন্তু আমরা লক্ষ করলে দেখতে পারবো আমরা যে চার্জার ব্যবহার করছি সেখানে এমন কিছু ডিভাইস আছে যা এসি বিদ্যুৎ কে ডিসি বিদ্যুতে পরিনত করে দিয়েছে।


তবে বর্তমানে কিছু ডিভাইস আছে যেগুলোতে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স পার্ট দুটই বিদ্যমান থাকে যেমন- ফ্রিজ, এসি, আইপি এস ইত্যাদি।

আপনাদের বুঝার সুবিধার্থে আরো সহজভাবে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স এর কয়েকটি পার্থক্য তুলে ধরা হলো-
  • ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইসগুলো মূলত ইলেকট্রিক্যাল শক্তি ব্যবহার করে অন্য কোন শক্তিতে রুপান্তর করে। যেমন- তাপশক্তি, আলোকশক্তি, রাসায়নিক শক্তি ইত্যাদি। আর ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসগুলো মূলত জায়গাভেদে ইলেকট্রনের প্রবাহকে বা চলাফেরাকে নিয়ন্ত্রন করে থাকে।
  • ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইসগুলোতে বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য তামা অথবা অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি তার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অপরদিকে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসগুলোতে ইলেকট্রন প্রবাহের জন্য বিভিন্ন ধরনের সেমিকন্ডাক্টর ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। 
  • ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইসগুলো অল্টারনেটিং (AC) কারেন্ট দিয়ে পরিচালিত হয়। অন্যদিকে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসগুলো ডাইরেক্ট কারেন্ট (DC দ্বারা পরিচালিত হয়।
  • ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইসগুলো হাই ভোল্টেজে পরিচালিত হয়ে থাকে অপরদিকে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসগুলো লো- ভোল্টেজে পরিচালিত হয়।
  • ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইসের পাওয়ার অপচয় বেশি অন্যদিকে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসগুলোর পাওয়ার অপচয় কম হয়।
  • ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইস ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস থেকে অনেক বেশি বিপদজ্জনক। আমাদের দেশে বিদ্যুৎ শক করে অনেক বড় দুঃঘটনার অনেক উদাহরন আছে।
  • ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইসগুলোর পরিবাহিতা ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসগুলোর তুলনায় অনেক বেশি।
  • ট্রান্সফরমার, মটর, জেনারেটর, বৈদ্যুতিক পাখা ইত্যাদি হল ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইসের উদাহরন। আর অন্যদিকে ডায়োট, ট্রানজিস্টর, মাইক্রোকন্ট্রোলার ইত্যাদি হলো ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস।
  • ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইসগুলো নিজেরা বিদ্যুতের চলাচলকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে না কিন্তু ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসগুলো বিদ্যুতের চলাচলকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে।

পরিবাহী, অর্ধপরিবাহী ও অপরিবাহী পদার্থ

আমরা বিদ্যুতের যে সকল শাখায় কাজ করে থাকি সেখানে মূলত পরিবাহী, অর্ধপরিবাহী ও অপরিবাহী পদার্থ থাকে। তাই আমাদের প্রথমেই এটা জানা উচিত যে পরিবাহি, অর্ধপরিবাহী ও অপরিবাহী পদার্থ কি?

পরিবাহী | Conductor

যে সকল পদার্থের ভিতরে বিদ্যুৎ খুব সহজে চলাচল করতে পারে তাকে পরিবাহী পদার্থ বা কন্ডাক্টর বলা হয়। যেমন- সোনা, তামা, রুপা, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি। তবে সোনা, রুপা ও তামাকে সুপরিবাহী পদার্থ বলা হয়ে থাকে। তবে কখনো যদি প্রশ্ন অসে সবচেয়ে ভালো পরিবাহী পদার্থের নাম কি? তাহলে তার উত্তর হবে রুপা।
তবে পরিবাহী পদার্থের বৈজ্ঞানিক সজ্ঞা হলো যে সকল পদার্থের সর্বশেষ কক্ষপথে ৪টির কম ইলেকট্রন থাকে তাকে পরিবাহী পদার্থ বলে।

অর্ধ-পরিবাহী | Semi - Conductor

যে সকল পদার্থের ভিতরে বিদ্যুৎ মাঝেমাঝে চলাচল করতে পারে তবে খুব সামান্য মাত্রায় এমন ধরনের পদার্থকে অর্ধপরিবাহী বা সেমিকন্ডাক্টর পদার্থ বলে। যেমন- সিলিকন, জার্মেনিয়াম ইত্যাদি।
অর্ধপরিবাহী পদার্থের বৈজ্ঞানিক সজ্ঞা হলো- যে সকল পদার্থের ভ্যালেন্স ইলেকট্রন সংখ্যা ৪ তাকেই অর্ধপরিবাহী পদার্থ বলে।

অপরিবাহী বা অন্তরক | Insulator

যে সকল পদার্থের ভিতরে বিদ্যুৎ কোনভাবেই চলাচল করতে পারে না সেসকল পদার্থকে অপরিবাহী পদার্থ বা অন্তরক বলা হয়ে থাকে। যেমন- কাঁচ, রাবার, শুকনা কাঠ, শুকনা বাঁশ, মাইকা ইত্যাদি। অপরিবাহী পদার্থকে ইংরেজিতে ইন্সুলেটর (Insulator) বলে।
অপরিবাহী পদার্থের বৈজ্ঞানিক সজ্ঞা হলো যে সকল পদার্থের সর্বশেষ কক্ষপথে ৪টির বেশি ইলেকট্রন থাকে তাকে অপরিবাহী পদার্থ বলে।


আপনাদের মাঝে এতক্ষন ধরে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স এর মধ্যাকার পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আশাকরি বিষয়টি আপনারা খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন। আমার লেখনিতে যদি কোন ভূল হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে আমাকে জানাবেন।  

মনোযোগ দিয়ে পুরো পোস্ট পড়ার জন্য সকলকে ধন্যবাদ। এমন নিত্যনতুন পোস্ট পেতে আমাদের উপায় কি ওয়েবসাইট সবসময় ভিজিট করার অনুরোধ করছি।

আপনার জন্য আরো কিছু পোস্টঃ

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

উপায় কী এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url